ইমাম খাইর, সিবিএন:
মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে অস্থায়ী রোহিঙ্গা সার্জারী ইউনিট। সেখানে এ পর্যন্ত ১০৮ জন রোগীর চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়েছে। প্রসব হয়েছে ৪ সন্তানের। সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি অগ্নিদগ্ধ রোগীর সেবাও দেয়া হচ্ছে অস্থায়ী রোহিঙ্গা সার্জারী ইউনিটে।
জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডাঃ মোঃ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী সিবিএনকে জানান, প্রথমে সাধারণ ওয়ার্ডে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। পরবর্তীতে রোগীর পরিমাণ বাড়তে থাকায় হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় তাদের জন্য আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই ব্লকে ৫টি কক্ষ। সেখানে ৩ শিফটে নিয়োজিত চিকিৎসকরা ২৪ ঘন্টা সেবা দিচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা ইউনিটে ৩১ রোগী ভর্তি আছে। এই ইউনিটে দুইজনের অপারেশনসহ ৪ শিশুর জন্ম হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ছাড়াও কুতুপালং কমিউনিটি ক্লিনিক, এমএসএফ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালেও রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট। কুতুপালং এলাকায় তারা আলাদা ক্যাম্প বসিয়ে ফ্রি-চিকিৎসা দিচ্ছে।
জাতিসংঘ এবং ‘আইওএম’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে এ পর্যন্ত চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ, জখমসহ নানাবিদ রোগে আক্রান্ত। যারা গুরুতর আহত তারা এখন ভিড় করছে জেলা সদর হাসপাতালে। খোলা হয়েছে আলাদা রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিট।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে আগুন, গুলি, দা, বোমার আঘাতে আহত। এছাড়া পালিয়ে আসা অধিকাংশই ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত। গত কয়েক দিনে মারাত্মক জখম রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়তে থাকায় সদর হাসপাতালে ভিড় করছে এসব রোগীরা।
উখিয়া-টেকনাফের এনজিও ও জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালগুলোতে জায়গা না হওয়ায় তারা ছুটছে জেলা সদর হাসপাতালে। সদর হাসপাতালে রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোহিঙ্গা নারী মরিয়ম, শাহেনা আক্তার, ফরিদা বেগম, আব্দুল জব্বারসহ অনেকে জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের পর অনেকে আহতবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও সেখানে খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স উম্মে সালমা বলেন, প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি। এসব রোহিঙ্গা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালের নানা ব্যস্ততার মাঝেও স্থানীয় রোগীদের মতো রোহিঙ্গাদেরও নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছি।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিটের ইনচার্জ শামসুন্নাহার বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য খোলা হয়েছে আলাদা সার্জারি ইউনিট। ইউনিটে রয়েছে সার্জারি, গুলিবিদ্ধ ও পোড়া রোগী। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ভর্তি রয়েছে ৩১ রোগী। এদের মধ্যে ১৮ জন নারী ও ১৩ জন পুরুষ।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগষ্ট রাতে মিয়ানমারের কয়েকটি সেনা ও পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা জঙ্গি হামলার অভিযোগে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন শুরু করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চার লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি। রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও তারা রাজি নয়।
রোহিঙ্গাদের এই স্রোত ঠেকাতে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মতো কোনো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে একাধিক নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। এছাড়া সীমান্তে যৌথ টহলেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো প্রস্তাবেই মিয়ানমারের সাড়া মেলেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকা- শুরু করে।